আমরা প্রায় সময় শুনে থাকি NFC শব্দটির কথা আবার মোটামোটি ভাল দামের মোবাইল ফোন গুলোতে NFC অপশন দেখি। তবে আমরা অনেকেই জানি না NFC আসলে কি? এটি আমাদের কি কাজে আসে? তাই আজকের আর্টিকেলে আমরা জানার চেষ্টা করবো NFC কি এবং NFC কিভাবে কাজ করে?
NFC শব্দটির পূর্ণরূপ হলো Near Field Communication। নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (NFC) হল যোগাযোগ প্রোটোকলের একটি সেট যা কিনা ৪ সেন্টিমিটার বা কম দূরত্বের দুটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে থাকে। এই প্রযুক্তিতে আপনি দ্বিমুখী যোগাযোগ করতে পারবেন, যেখানে আপনি উভয় ডিভাইসে তথ্য পাঠাতে এবং তথ্য গ্রহন করতে পারবেন।
আরও পড়ুনঃ রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের যাত্রা ও ইতিহাস
নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন সংযোগটি Wi-Fi এর মতো যেকোনো প্রযুক্তিতে উপলব্ধ। RFID প্রযুক্তি থেকে মূলত নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (NFC) প্রযুক্তির উৎপত্তি হয়েছে। NFC প্রথম ১৯ জানুয়ারি ২০০৯ খ্রি. চংকিং এর ট্রামওয়ে এবং বাসে চায়না ইউনিকম এবং ইউচেং ট্রান্সপোটেশন কার্ড দ্বারা পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। তারপর ২০১০ সালে শেষের দিকে বেইজিংয়ে চায়না ইউনিকম দ্বারা একটি মেট্রো নেটওয়ার্কে প্রথমবারের জন্য প্রয়োগ করা হয়।
NFC সবসময় কম শক্তি এবং স্বল্প ফ্রিকোয়েন্সি পরিসরে কাজ করে। এর ফ্রিকোয়েন্সি ১৩.৫৬ মেগাহার্টস। আর এটির স্পেসিফিকেশন হলো ISO/IEC 14443 (যা স্মার্ট কার্ডের মধ্যে তথ্য সংরক্ষণ করে) এবং ISO/IEC 18000-3 (স্মার্ট ডিভাইসের RFID ট্যাগে ব্যবহৃত হয়)।
NFC কত প্রকার:
NFC ডিভাইস অনুযায়ী প্রধানত দুই প্রকার।
১. Active NFC Device
2. Passive NFC Device
Active NFC Device:
Active NFC Device বলতে মূলত সেই ডিভাইস গুলোকে বোঝানো হয়, যে গুলো ডেটা পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে পারে এবং এর মাধ্যমে তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। সক্রিয় এনএফসি ডিভাইসে কাজ করার জন্য একটি শক্তির উৎস প্রয়োজন হয় এবং এগুলোর তথ্য প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা থাকে। বর্তমানে যে স্মার্টফোন গুলো বাজারে রয়েছে এগুলোতে সক্রিয় এনএফসি ডিভাইস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাছাড়াও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট কার্ড রিডার এবং টাচ পেমেন্ট টার্মিনাল গুলিও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুনঃ বিটকয়েন (Bitcoin) কি ও কিভাবে কাজ করে?
Passive NFC Device:
Passive NFC Device বলতে সেই ডিভাইস গুলোকে বুঝায়, যে গুলো শুধুমাত্র অন্যান্য এনএফসি ডিভাইসে তথ্য পাঠাতে সক্ষম। এগুলোর অপারেশন পরিচালনার জন্য কোন প্রকার বাহ্যিক শক্তির দরকার পরে না। এগুলো ডিভাইসের তথ্য প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা নেই। এগুলো ট্যাগ ও অন্যান্য ছোট ট্রান্সমিটারে বেশি ব্যবহৃত হয়।
NFC কিভাবে কাজ করে?
বর্তমানে আমরা যে সকল ফ্রিকোয়েন্সি গুলো সম্পর্কে জানি যেমন Bluetooth, Wi-Fi এবং অন্যান্য বেতার সংকেতের মতো এনএফসি ডিভাইসও বেতার সংকেতের মাধ্যমে তথ্য পাঠিয়ে থাকে।
নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন বেতার ডেটা ট্রানজিশনের জন্য একটি ভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড ফলো করে থাকে। অর্থাৎ ডিভাইস গুলোকে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু স্পেসিপিকেশন মেনে চলতে হয়। এনএফসি তে যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় তা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (RFID) প্রযুক্তি থেকে উদ্ভূত, যা পূর্বে তথ্য প্রেরণের জন্য Electromagnetic Induction ব্যবহৃত হত।
এনএফসি প্যাসিভ কম্পোনেন্টে বৈদুতিক কারেন্ট প্ররোচিত করতে ও তথ্য পাঠাতে ব্যবহৃত হয়। এখানে এটি দেখায় যে প্যাসিভ ডিভাইসটি চালানোর জন্য নিজস্ব কোন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রযোজন হয় না। তারা মূলত শক্তি পায় যখন একটি সক্রিয় এনএফসি উপাদান তাদের মধ্য দিয়ে যায় বা তাদের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি Electromagnetic Induction তৈরি হয় যার ফলে শক্তি উৎপন্ন করে।
এনএফসি প্রযুক্তিতে তথ্য ট্রান্সমিশন ফ্রিকোয়েন্সি ১৩.৫৬ মেগাহার্টস। আপনি এটি ১০৬, ২১২ ও ৪২৪ হিসেবে প্রবেশ করতে পারেন। এটি প্রতি সেকেন্ডে কিলোবিট গতিতে ডেটা পাঠাতে সক্ষম। আর স্বল্প ডেটা প্রেরণের জন্য এটি যথেষ্ট যেমন যোগাযোগের বিবরণ পাঠানো, ছবি বা সঙ্গীত ও অর্থ প্রদানের জন্য।
দুটি ডিভেইসের মধ্যে কি ধরণের তথ্য আদান-প্রদান হয় তা নির্ধারণ করার জন্য এনএফসি ৩টি স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে বিভক্ত।
পিয়ার টু পিয়ার:
পিয়ার টু পিয়ার পদ্ধতিটি সর্বাধিক ব্যবহৃত একটি মোড। এটি মূলত ফাইল স্থানান্তরের জন্য স্মার্টফোন গুলোতে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই মোডে উভয় ডিভাইস ডেটা পাঠানোর সময় সক্রিয় মোড এবং ডেটা গ্রহন করার সময় প্যাসিভ মোডে পরিবর্তিত হয়।
Reader/Writer:
Reader/Writer মোড হলো একটি একমুখী ডেটা ট্রান্সমিশন মোড। এখানে Active Device যা আপনার স্মার্টফোনও হতে পারে এবং সেখান থেকে তথ্য Read করার জন্য অন্য একটি ডিভাইসের সাথে সংযোগ স্থাপন করে থাকে। এই মোড মূলত বিজ্ঞাপন ট্যাগে ব্যবহৃত হয়।
কার্ড এমুলেশন:
এটি অপারেশনের চূড়ান্ত মোড। এখানে এনএফসি ডিভাইসটি স্মার্ট বা কন্টাক্টলেস ক্রেডিট কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা যায় এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে ট্যাপ করে সহজেই পেমেন্ট করা যায়।
NFC ব্যবহারের সুবিধা:
- কোন কিছু কেনার পর পেমেন্ট করার ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করার ফলে অনেক সময় বেচে যায়। কারণ অনেকেই মানিব্যাগ বা ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করতে চায় না। তাই এই প্রযু্ক্তি ব্যবহারের ফলে নিজের মোবাইল ডিভাইসটিকে মানিব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করে পেমেন্ট করা যায়। এতে সময় ও ঝুকি অনেক কমে যায়।
- এনএফসি সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়া যায়। আপনি ব্যাংক কার্ড, মুভি পাস, রিওয়ার্ড সিস্টেম বা কী ব্যবহার করে ট্রানজিট পাসের জন্য যে কোনো পরিস্থিতি ব্যবহার করা যায়।
- এনএফসি আবির্ভাবের ফলে অনেক কাজ স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায়, যা কাস্টোমার পরিষেবাকে ত্বরান্বিত করে।
- যেহেতু এনএফসি এর সাহায্যে অনেক জায়গা থেকে রিয়েল টাইম ডেটা আনা যায়, ফলে অনেক কাজ সহজে করা সম্ভব হয়।
- এনএফসি সক্ষম ক্রেডিট কার্ডগুলি ক্রেডিট কার্ডের চুম্বকীয় স্ট্রিপের চেয়ে বেশি নিরাপদ হয়ে থাকে। এতে লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পাদন করার জন্য একটি পিন থাকে যা এটিকে আরও বেশি নিরাপদ করে তোলে।
NFC ব্যবহারের অসুবিধা:
প্রতিটি প্রযুক্তির যে রকম সুবিধা রয়েছে ঠিক তেমন অসুবিধাও রয়েছে।
- যেহেতু এনএফসি সম্পূর্ণরূপে মোবাইল ফোনে একীভূত হয়েছে তাই যদি কখনও হ্যাকারদের দ্বারা ফোন হ্যাক হয় তাহলে তারা আপনার সব গোপনীয় তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তখন এনএফসি নিরাপদ বলে বিবেচিত হবে না।
- এনএফসি বলছে যে এটি যে কোনো জায়গায় এবং যে কোনো সময় ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভাবে সঠিক নয় কারণ অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা এনএফসি ব্যবহার সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ।
- এনএফসি অনেক ডিভাইসে না থাকায় এর ব্যবহার কম পরিসরে হয়ে থাকে।
- এনএফসি অন্যান্য প্রযুক্তি গুলো থেকে কিছুটা ব্যয়বহুল তাই অনেকের কাছে এটি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।
NFC যে সকল ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়:
বর্তমানে এনএফসি ব্যবহার অনেক বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। নিচে এর ব্যবহার গুলো আলোচনা করা হলো।
- স্মার্ট কার্ড: এনএফসি ইন্টিগ্রেটেড স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করে পেমেন্ট করা সহজ এবং একাধিক ধাপের পেমেন্ট প্রক্রিয়ার চেয়ে অনেক সহজ। বর্তমানে শীর্ষ পেমেন্ট পরিষেবা যেমন ভিসা ও মাস্টারকার্ড গুলোতে NFC এমবেডেড স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করে থাকে। দ্রুত পার্কিং, পার্কিং টিকিট, শপিং পয়েন্ট যোগ করা, কুপন ভাঙ্গানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে এনএফসি ইন্টিগ্রেটেড স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করা হয়।
- ই-ওয়ালেট: বর্তমানে ক্যাশ বিহীন পেমেন্ট পদ্ধতি বহুগুণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানকারীরা স্মার্টফোনের সাথে পেমেন্ট অপশন যুক্ত করছে যার জন্য তাদের একটি এনএফসি ট্যাগ ডিভাইসে এম্বেড করা থাকে। যেমন- অ্যাপেল পে, গুগল ওয়ালেট ইত্যাদি।
- স্মার্ট টিকেট: ইন্টিগ্রেটেড স্মার্ট চিপ ব্যবহার করে স্মার্ট টিকেটের ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বিমান বাস ও ট্রেনে (মেট্রোরেল) এধরণের স্মার্ট টিকেট ব্যবহার করা।
- স্মার্ট ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট: স্মার্ট RFID ট্যাগ গুলো খুচরা দোকান এবং বৃহৎ আকারের সুপার মার্কেটে ইনভেন্টরিগুলোর ভাল ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হয়। স্মার্ট ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট সফ্টোওয়ার এর মাধ্যমে সহজেই রিয়েল টাইমে আপডেট করা যায় যাতে স্টকগুলোতে কি পরিমান আইটেম রয়েছে এবং শেষ হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে অগ্রিম ধারণা পাওয়া যায়।
- চুরি নিয়ন্ত্রণ: বর্তমানে চুরি নিয়ন্ত্রণে RFID ট্যাগ ব্যবহার করা হয়। যে সকল বস্তু যার মধ্যে স্মার্ট RFID ট্যাগ এম্বেড করা আছে সেগুলো যদি RFID প্রক্সিমিটির কাছাকাছি চলে যায় তবে যে ট্রিগার তৈরি হয় তার দ্বারা চুরি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
Info IT BD সকল আপডেট পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেলে
পরিশেষে বলতে গেলে এনএফসি প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে স্মার্ট করার পাশাপাশি অনেক সহজও করেছে। আশাকরি আজকের আর্টিকেলটির মাধ্যমে এনএফসি বিষয়ে কিছুটা হলেও আপনাদেরকে জানাতে পেরেছি।